SM IT

কালিমা শাহাদাত সত্য সাক্ষ্য

কালিমা শাহাদাতে এই ঘোষণাই দেওয়া হয়, ‘আশহাদু আল্লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু, ওয়াহদাহু লা শারিকা লাহু; ওয়া আশহাদু আন্না মুহাম্মাদান আবদুহু ওয়া রাসুলুহু।’ অর্থাৎ ‘আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে এক আল্লাহ ব্যতীত আর কোনো মাবুদ নাই, তিনি এক ও একক, তাঁর কোনো শরিক বা অংশীদার নাই; আমি আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি নিশ্চয়ই হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহ তায়ালার অতি প্রিয় খাস বান্দা ও তাঁর প্রেরিত রাসুল।’

মহান আল্লাহ তায়ালা হলেন পরম সত্য বা মহাসত্য। এই সত্যের সাক্ষ্যই হলো ইমান বা ইমানের দাবি। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব প্রিয় নবী আখেরি নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) হলেন মহাসত্যবাদী ও পরম বিশ্বাসী বা বিশ্বস্ত ব্যক্তি। তাঁর সত্য নবুয়ত ও রিসালাতের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন ও নিঃশর্ত সাক্ষ্য প্রদান ইমানেরই অংশ। তাঁর প্রতি আস্থা, বিশ্বাস ও ভালোবাসা হলো ইমান। তাঁর আনুগত্য ও অনুসরণ হলো ইসলাম।

সাক্ষ্য দেওয়ার পূর্বশর্ত হলো প্রত্যক্ষ করা বা স্বচক্ষে অবলোকন করা বা দেখা। মহান আল্লাহ তায়ালা এমনই পরম সত্য, যা দৃশ্যমান হওয়া দিবালোকের মতো সুস্পষ্ট; তাই এটি প্রত্যক্ষকারীদের অপেক্ষা রাখে না। প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর সততা ও সত্যবাদিতা জগৎ–খ্যাত ও প্রশ্নাতীত। যারা তাঁর জানের দুশমন ও প্রাণের শত্রু ছিল, তারাও তাঁর সত্যতা ও বিশ্বস্ততার প্রতি দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেছে। এ বিষয় দুটি উদ্ধৃত হয়েছে এভাবে, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মালিকুল হাক্কুল মুবিন, মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহি ছদিকুল ওয়াদিল আমিন।’ অর্থাৎ ‘এক আল্লাহ ছাড়া দ্বিতীয় কোনো মাবুদ নেই, তিনি শাসক অধিপতি, তিনিই সুস্পষ্ট ও পরম সত্য; হজরত মুহাম্মদ (সা.) মহান আল্লাহর প্রেরিত রাসুল, চরম সত্যবাদী, ওয়াদা ও অঙ্গীকার রক্ষাকারী এবং পরম বিশ্বস্ত ও অতি বিশ্বাসী। (আল মুফরাদাত, বুখারি)। সব নবী ও রাসুল সত্যবাদী ছিলেন। আল্লাহ তায়ালা কোরআন কারিমে বলেন, ‘আপনি এই গ্রন্থে হজরত ইব্রাহিম (আ.)-এর বিষয় আলোচনা করুন, নিশ্চয় তিনি ছিলেন সত্যবাদী নবী।’ (সুরা-১৯ [৪৪] মারিয়াম, রুকু: ৩, আয়াত: ৪১, পারা: ১৬)।

ইসলামের শিক্ষাসমূহের প্রধান তিনটি শিক্ষা হলো: সত্যতা, পবিত্রতা ও প্রেম। আল্লাহ তায়ালাকে পেতে হলে তাঁর প্রতি প্রেম থাকতে হবে; তাঁর প্রিয়তম মানুষ হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রতি বিশ্বাস ও ভালোবাসা থাকতে হবে, থাকতে হবে পূর্ণ আনুগত্য; এটাই হলো প্রেম। আল্লাহ তায়ালা পবিত্র, তিনি ‘সুব্বুহুন কুদ্দুস’ তথা পরম পবিত্র; তাঁর প্রিয় হাবিব হজরত মুহাম্মদ (সা.) সর্বদা পবিত্র জীবন যাপন করেছেন। তাই আল্লাহ ও তাঁর রাসুল হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রেমিক হতে হলে তাকে পবিত্র জীবন যাপন করতে হবে; এটাই হলো পবিত্রতা। ইমান ও ইসলামের জন্য যেহেতু জীবনের পবিত্রতা শর্ত, তাই বিশ্বাসী মোমিন বান্দাকে সদা সত্যাশ্রয়ী হতে হয়; এটাই হলো সত্যতা। আশেক ও মাশুকের মাঝে আড়াল থাকে না, সুতরাং এখানে মিথ্যার অনুপ্রবেশের সুযোগই থাকে না। মিথ্যার ধূম্রজাল হলো বেড়া বা আড়াল; মিথ্যা যেখানে আসে সেখানে প্রেম থাকে না।

সত্যতা মানুষকে সব কলুষ ও কালিমা থেকে পবিত্র করে, পবিত্রতা মানুষের মাঝে প্রেমভাব জাগ্রত করে; শুদ্ধাচারের প্রতি উদ্বুদ্ধ করে, শুদ্ধাচার বা পবিত্রতা মানুষকে সত্যতা বা পরম সত্যে উপনীত করে।

সত্য সাক্ষ্যদানের মাধ্যমেই মোমিনের ইমানের সূচনা হয়; তাই মোমিন ব্যক্তির সারা জীবন এই সত্যকে আঁকড়ে ধরে রাখতে হয়; এ যে তার ইমান, তার বিশ্বাস। বিশ্বাসের সঙ্গে প্রতারণা বা বিশ্বাসঘাতকতা আত্মপ্রবঞ্চনার শামিল।

সত্য ব্যতীত মানুষ মোমিন হয় না; মুসলমান কখনো অসত্য বলে না। ইসলামে সব সময় সত্য বলা ও সত্য সাক্ষ্য দেওয়া ফরজ ইবাদত ও জরুরি কর্তব্য বলে পরিগণিত। এই সত্যতা মনোজগতে, চিন্তাচেতনায়, কল্পনায় ও পরিকল্পনায়। এই সত্যতা মুখের ভাষায়। এই সত্যতা যাবতীয় কর্মকাণ্ডে, অঙ্গপ্রত্যঙ্গে। সত্যতা বা সততা প্রতিটি কদমে বা পদক্ষেপে; সত্যতা বা সততা প্রতিটি ছোঁয়া বা স্পর্শে; সত্যতা বা সততা প্রতিটি দৃষ্টি–পলক বা ভ্রু-কুঞ্চনে; সত্যতা বা সততা প্রতিটি ধ্বনিতে, প্রতিটি শব্দে ও প্রতিটি বাক্যে; সত্যতা বা সততা প্রতিটি শ্রবণে ও অনুভবে।

অসত্য ভাষণ, মিথ্যা বিবৃতি, মিথ্যা অভিযোগ, মিথ্যা সাক্ষ্য সমাজকে কলুষিত করে। এর দ্বারা ন্যায়বিচার বা সুশাসনের বিলুপ্তি ঘটে। সৎশাসনের অভাবে সমাজে অন্যায়, অত্যাচার, জুলুম, অনাচার বেড়ে গিয়ে অরাজকতার সৃষ্টি হয়।

সত্যের বিপরীত হলো মিথ্যা বা অসত্য। মিথ্যা বলা হারাম ও চরম পাপকার্য। হাদিস শরিফে রয়েছে, ‘মিথ্যা পাপের জননী।’ (বুখারি শরিফ)। ‘সত্য মানুষকে মুক্তি দেয়, মিথ্যা মানুষকে ধ্বংস করে দেয়।’ কারণ, মানুষ যখন হারাম বা পাপকার্য সংঘটন করে, তখন তার ইমান বা বিশ্বাস তার সঙ্গে সক্রিয় থাকে না। তখন তার ইমান বা বিশ্বাস তার থেকে আলাদা হয়ে শূন্যে ঝুলতে থাকে; যতক্ষণ পর্যন্ত সে ওই মিথ্যায় বা পাপে লিপ্ত থাকে। (বুখারি শরিফ ও মুসলিম শরিফ)। পুনরায় তওবা করে অনুতপ্ত হয়ে মিথ্যা ও পাপ বর্জনের দৃঢ় প্রত্যয় গ্রহণ করলেই ইমান আবার তার কাছে ফিরে আসে। (ফাতাওয়া আলমগিরি)।

মিথ্যার পরিণতি সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তোমরা জগতে ভ্রমণ করো ও দেখো, মিথ্যাবাদীদের কী পরিণতি হয়েছিল!’ (সুরা-৩ [৮৯] আলে ইমরান, রুকু: ১৪, আয়াত: ১৩৭, পারা: ৪)।

রোজ কিয়ামতে হাশরের ময়দানে বিচারের সময় মানুষ নিজের প্রতি সাক্ষ্য দেবে। যারা ইহজগতে মিথ্যা বলে অভ্যস্ত তারা পরকালে মিথ্যা; তারা নিষ্পাপ পবিত্রাত্মা ফেরেশতাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ তুলবে। তখন মহান আল্লাহ তায়ালা তাদের জবান বন্ধ করে দিয়ে তাদের পাপ সম্পাদনকারী অঙ্গপ্রত্যঙ্গের সাক্ষ্য নেবেন। ‘আজ আমি তাদের মুখে সিলমোহর করে দেব; তাদের হস্তসমূহ আমার সঙ্গে কথা বলবে এবং তাদের পাগুলো সাক্ষ্য দেবে, যা তারা (মিথ্যা-পাপ) অর্জন করেছিল। (সুরা-৩৬ [৪১] ইয়াছিন, রুকু: ৪, আয়াত: ৬৫, পারা: ২৩)। এমতাবস্থায় গত্যন্তর না দেখে কিছু লোক সত্য স্বীকার করবে (যদিও সেদিন তা কোনো কাজে আসবে না)।

একমাত্র সত্য সাক্ষ্য ও ন্যায় বিধানই পারে সমাজে দেশে বা রাষ্ট্রে শাস্তি বজায় রাখতে ও শৃঙ্খলা আনতে। আল্লাহ ন্যায়বান, তিনি ন্যায়বিচার করবেন।

প্রতিটি হারাম কর্ম ও হারাম বস্তু কবিরা গুনাহ বা বড় পাপ। মিথ্যা হলো পাপের আকর বা মহাপাপ। স্বেচ্ছায় অভ্যাসে প্রকাশ্যে কবিরা গুনাহ করলে এবং তা থেকে খাঁটি তাওবা না করলে তাকে ফাসিক বলা হয়। ফাসিক অর্থ গুনাহগার বা পাপাচারী; ইসলামি আদালতে ফাসিকের সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ সে কালিমা শাহাদাতের সাক্ষ্য ভঙ্গ করেছে। সুতরাং মোমিনের উচিত মৃত্যু পর্যন্ত সারা জীবন কালিমা শাহাদাতের সাক্ষ্যের ওপর দৃঢ় অবিচল থেকে স্বীয় ইমান ও ইসলাম রক্ষা করা।

মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী: যুগ্ম মহাসচিব, বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি, সহকারী অধ্যাপক, আহ্‌ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম।

Next
This is the most recent post.
Previous
Older Post

Post a Comment