উত্তর :
নামাযে মুসল্লি বুকের উপর হাত বাঁধার পক্ষে সহিহ, সরীহ ও মুত্তাফাক আলাইহি কোনো ধরণের হাদিস উল্লেখ পাওয়া যায় না। কিন্তু তা সত্ত্বেও সম্প্রতি কতিপয় গায়রে মুকাল্লিদ ও লা-মাযহাবীদের ভুল ব্যাখ্যার কারণে স্বাধারণ মুসল্লিগণ প্রতিনিয়ত বিভ্রান্ত হচ্ছেন।
১ হাদিস রয়েছে যা ওয়ায়েল বিন হুজুর (রা) থেকে বর্নিত কিন্তু ইহা সনদের দিক থেকে অত্যন্ত দুর্বল। কেননা হাদিসটির একটি সনদে একজন রাবী হলেন মুয়াম্মল ইবনে ইসমাইল।
তিনি প্রখ্যাত ছিকাহ রাবী ইমাম সুফিয়ান সাওরী (রহঃ) থেকেই উক্ত হাদিসটি বর্ণনা করেছেন।
কিন্তু হাদিসটি আরো আটটি (৮) সনদে বর্ণিত হওয়ার প্রমাণ পাওয়া যায়। যার সবগুলোই ইমাম সুফিয়ান সাওরী (রহঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে। অথচ আটটি সনদের কোনো একটিতেও علي صدره (বুকের উপর) কথাটুকু পাওয়া যায় না। শুধুমাত্র মুয়াম্মল ইবনে ইসমাইল এর বর্ণিত হাদিসেই علي صدره (বুকের উপর) কথাটুকু পাওয়া যায়, যিনি منكر الحديث তথা হাদিসের জগতে পরিত্যাজ্য। তাই ধারণা করা যাচ্ছে যে, “বুকের উপর” অংশটুকু তারই বৃদ্ধিকৃত। ফলে তা বাতিল। মজার ব্যাপার হল, ইমাম সুফিয়ান সাওরী (রহঃ) নিজেও علي صدره (বুকের উপর) কথাটুকুর উপর আমল করতেন না। তাহলে সেটি কিভাবে তাঁর থেকে علي صدره (বুকের উপর)— অংশটুকু সহকারে বর্ণিত হতে পারে!
হাদিসটির সনদ এরকম :
↓
হাদিসের সংকলক তিনি আবু তাহের থেকে তিনি আবু বকর থেকে তিনি আবু মূসা থেকে তিনি মুয়াম্মল ইবনে ইসমাইল থেকে তিনি হযরত সুফিয়ান সাওরী (রহঃ) থেকে তিনি আছিম ইবনে কুলাইব থেকে তিনি স্বীয় পিতা থেকে তিনি সাহাবী হযরত ওয়ায়েল ইবনে হুজর (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেছেন।
– ﺃﺧﺒﺮﻧﺎ ﺃﺑﻮ ﻃﺎﻫﺮ ، ﻧﺎ ﺃﺑﻮ ﺑﻜﺮ ، ﻧﺎ ﺃﺑﻮ ﻣﻮﺳﻰ ، ﻧﺎ ﻣﺆﻣﻞ ، ﻧﺎ ﺳﻔﻴﺎﻥ ، ﻋﻦ ﻋﺎﺻﻢ ﺑﻦ ﻛﻠﻴﺐ ، ﻋﻦ ﺃﺑﻴﻪ ، ﻋﻦ ﻭﺍﺋﻞ ﺑﻦ ﺣﺠﺮ ﻗﺎﻝ : ” ﺻﻠﻴﺖ ﻣﻊ ﺭﺳﻮﻝ ﺍﻟﻠﻪ – ﺻﻠﻰ ﺍﻟﻠﻪ ﻋﻠﻴﻪ ﻭﺳﻠﻢ – ، ﻭﻭﺿﻊ ﻳﺪﻩ ﺍﻟﻴﻤﻨﻰ ﻋﻠﻰ ﻳﺪﻩ ﺍﻟﻴﺴﺮﻯ ﻋﻠﻰ ﺻﺪﺭﻩ
অর্থাৎ আমি আল্লাহ’র রাসুল (সাঃ)-এর সাথে নামায পড়েছিলাম। তিনি (নামাযে) তাঁর ডান হাত বাম হাতের উপর বুকের উপর রাখলেন।
(সহিহ ইবনে খুযায়মা ১/২৭২ , হাদিস নং ৪৭৯)।
Note :
প্রথমত : রাবী মুয়াম্মল ইবনে ইসমাইলের সূত্রে উক্ত বর্ণনাটি সঠিক নয়। কেননা হাদিসশাস্ত্রের নীতিমালা অনুসারে এ বর্ণনায় (বুকের ওপর) কথাটা মুনকার । অর্থাৎ সুফিয়ান সাওরী (রহঃ)-থেকে অপরাপর আটটি বর্ণনায় علي صدره (বুকের উপর) কথাটুকুর উল্লেখ পাওয়া যায়না। সম্ভবত মুয়াম্মল ইবনে ইসমাইল ভুলক্রমে তা বৃদ্ধি করে দেন।
কেননা মুয়াম্মল ইবনে ইসমাইল এর উস্তাদ হলেন ইমাম সুফিয়ান সাওরী (রহঃ)। যাঁর কাছ থেকে হাদিসটি মুহাম্মাদ ইবনে ইউসুফ ফিরয়াবী এবং আবদুল্লাহ ইবনে ওয়ালীদ (রহঃ) সহ আরো অনেকে বর্ণনা করেছেন। যাদের সবাই ছিকাহ (বিশ্বস্ত) ও শক্তিশালী রাবী । কিন্তু তাদের কারোর রেওয়ায়েতে علي صدره (বুকের উপর) কথাটুকুর উল্লেখ পাওয়া যায়না।
(দেখুনঃ মুসনাদে আহমদ ৪/৩১৮, আল-মুজামুল কাবীর তিবরানী ২২/৩৩)।
মুয়াম্মল ইবনে ইসমাইল সম্পর্কে জারহ তা’দীলের ইমামদের সিদ্ধান্ত :
আগেই বলা হয়েছে যে, শুধুমাত্র মুয়াম্মল ইবনে ইসমাইল এর বর্ণিত হাদিসেই علي صدره (বুকের উপর) কথাটুকু পাওয়া যায়, যিনি منكر الحديث তথা হাদিসের জগতে পরিত্যাজ্য। ইমাম বুখারী, ইমাম যাহাবী এবং ইমাম বদরুদ্দীন আইনী (আলাইহিমুর রাহমাহ) তাকে منكر الحديث তথা হাদিসের জগতে পরিত্যাজ্য বলে উল্লেখ করেছেন।
(দেখুনঃ তাহযীবুল কামাল- ১৮/৫২৬, তাহযীবুত তাহযীব- ১০/৩৪০, মীযানুল- ইতিদাল ৮৯৪৯, আল-মুগনী ফি দ্বু’আফা- ৬৫৪৭)।
তার সম্পর্কে ইমাম আল্লামা মুরূযী (রহ) বলেছেন :
و قال محمد ابن نصر المروزي المؤمل إذا انفرد بحديث وجب ان يتوقف و يثبت فيه لأنه كان سيئ الحفظ كثير الغلط . ميزان الاعتدال ، تهذيب التهذيب : ٢٧٢
অর্থাৎ মুয়াম্মল ইবনে ইসমাইল তিনি যখন কোনো হাদিস একাকী বর্ণনা করবে তা গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকা উচিৎ। কেননা তার স্মরণ শক্তি দুর্বল ছিল এবং অনেক ভুলও করতেন বেশি। ”
( সূত্র— মীযানুল ইতিদাল, তাহযীবুত তাহযীব ২৭২)।
আশ্চর্যের বিষয় হল, লামাযহাবীদের শায়খ নাসীরুদ্দিন আলবানী তিনিও তার সিলসিলাতু আদ-দ্বয়ীফা’র কিতাবে অনক জায়গায় তাকে দ্বয়ীফ (দুর্বল) বলেছেন এবং তার সম্পর্কে ইমামগনের মন্তব্য উদ্ধৃত করেছেন ।
(দেখুনঃ সিলসিলাতু আদ-দ্বয়ীফা- ১/১৩১ , ২/২৪৬ , ৩/১৭৯, ৩/২২৭, ৪/৪৫৫ ইত্যাদি ।)
দ্বিতীয়তঃ হযরত সুফিয়ান সাওরী (রহঃ) তিনি হযরত ওয়ায়েল ইবনে হুজর (রাঃ)-এর রেওয়ায়তটি হযরত আছিম ইবনে কুলাইব থেকে বর্ণনা করেছেন ।
আছিম ইবনে কুলাইব থেকে এ হাদিস আরো যাঁরা বর্ণনা করেছেন তাঁরা হলেন-
১- বিশিষ্ট রাবী ইমাম শোবা ইবনুল হাজ্জাজ,
২- হযরত বিশর ইবনুল মুফাদ্দাল,
৩- হযরত কায়স ইবনুর রাবী,
৪- হযরত যাইদা ইবনে কুদামা,
৫- হযরত আব্দুল ওয়াহিদ ইবনে যিয়াদ,
৬- হযরত খালিদ ইবনু আবদিল্লাহ ,
৭- হযরত আবু ইসহাক,
৮- হযরত আবুল আহওয়াস,
৯- হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ইদরীস ,
১০- হযরত মুসা ইবনে আবী আয়েশা ,
১১- হযরত আবু আওয়ানা প্রমুখ। তাঁরা প্রত্যেকে হাদিসের বিখ্যাত ইমাম এবং ছিকাহ রাবী।
প্রত্যেকে আছিম ইবনে কুলাইব (রহ) থেকে নামাযে হাত বাঁধার হাদিসটি বর্ণনা করেছেন। কিন্তু উনাদের কেউ علي صدره (বুকের উপর) কথাটুকু উল্লেখ করেননি।
এদের রেওয়াতগুলোর জন্য নিচের তথ্যগুচ্ছ দেখা যেতে পারে।
যেমন,
মুসনাদে আহমদ- ৪/৩১৯, হাদিস নং ১৮৮৭৮;
সুনানে আবু দাউদ, হাদিস ৭২৬;
সূনানে নাসায়ী, কুবরা , হাদিস ১১৮৯;
মুজতাবা, হাদিস নং ১২৬৫;
মুসনাদে বাযযার আল-বাহরুয যাখখার, হাদিস নং ৪৪৮৫;
আল-মু’জামুল কাবীর তিবরানী ২২/৩৭;
আল-মুজামুল কাবীর, তিবরানী ২২/৩৩;
মুসনাদে আহমদ ৪/৩১৮;
আল-মুজামুল কাবীর ২২/৩৫;
মুসনাদে আহমদ ৪/৩১৬;
সুনানে কুবরা বায়হাকী ২/১৩১;
আল-মুজামুল আওসাত তিবরান ২/৪২৩;
মুসনাদে আবু দাউদ ত্বায়ালিসী ২/৩৫৮, হাদিস নং ১১১৩
আল-মুজামুল কাবীর তাবারানী ২২/৩৪;
সহীহ ইবনে হিববান ৫/২৭১;
মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবাহ ৩/৩১৭;
মুসনাদে বাযযার আল-বাহরুয যাখখার, হাদিস নং , ৪৪৮৯;
মারিফাতুস সুনানি ওয়াল আছার বায়হাকী ৩/৫০।
~
সুতরাং দীর্ঘালোনা দ্বারা সুস্পষ্টভাবে বুঝা গেল যে , আছিম ইবনে কুলাইব থেকে বুকের উপর হাত বাঁধার কথাটুকুর উল্লেখ নেই।
শুধুমাত্র মুয়াম্মল ইবনে ইসমাইল এর বর্ণিত হাদিসেই ﻋﻠﻲ ﺻﺪﺭﻩ (বুকের উপর) কথাটুকু পাওয়া যায়, যিনি ﻣﻨﻜﺮ ﺍﻟﺤﺪﻳﺚ তথা হাদিসের জগতে পরিত্যাজ্য। তাই ধারণা করা যাচ্ছে যে, “বুকের উপর” অংশটুকু তারই বৃদ্ধিকৃত। ফলে তা মুনকার ও বাতিল । যেজন্য লা-মাযহাবীরা “সহিহ ইবনে খোজাইমা” কিতাবের (হাদিস নং ৪৭৯) উদ্ধৃতি দিয়ে নামাযে বুকের উপর হাত বাঁধার পক্ষে যে হাদিসটি প্রদর্শন করে থাকেন সেটি অাদৌ আমলযোগ্য নয়।
Post a Comment