৯/ - ইবনে কাসীরের ভাষ্য
ইবনে কাসীর তার রচিত ‘আল-বেদায়া’ গ্রন্থের ৮ম খণ্ডের ১১৬৯ পৃষ্ঠায় ‘যিকরে এয়াযীদ বিন মোয়াবিয়া’ শীর্ষক অধ্যায়ে লিখেন:
”বিভিন্ন বর্ণনায় আমরা জানতে পারি যে এয়াযীদ দুনিয়ার কুকর্ম পছন্দ করতো; মদ্যপান করতো, গান-বাজনায় ছিল আসক্ত, দাড়িবিহীন ছেলেদের সাথে সমকামিতায় লিপ্ত, ঢোল বাজাতো, কুকুর পালতো, ব্যাঙের, ভালুকের ও বানরের লড়াই লাগিয়ে দিতো। প্রতিদিন সকালে সে মদ্যপ অবস্থায় বানরকে ঘোড়ার পিঠের সাথে বেঁধে ঘোড়াকে দৌড় দিতে বাধ্য করতো।” [আল-বেদায়া ওয়ান্ নেহায়া, ৮ম খণ্ড, ১১৬৯ পৃষ্ঠা]
১০/ - ইবনে আসীরের মন্তব্য
ইবনে আসীর নিজ ’তারীখ আল-কামিল’ গ্রন্থের ৩য় খণ্ডের ৪৫০ পৃষ্ঠায় মুনযির ইবনে যাবীর থেকে বর্ণনা করেন:
”এটি সত্য যে এয়াযীদ আমাকে ১,০০,০০০ (এক লক্ষ) দিরহাম পুরস্কারস্বরূপ দিয়েছিল, কিন্তু এটি তার প্রকৃত অবস্থা বর্ণনা করা হতে আমাকে রুখবে না। আল্লাহর কসম, সে একজন মাতাল।”
১১/ - ‘মাতাল’ এয়াযীদ সম্পর্কে ইবনে জাওযীর মন্তব্য
ইবনে জাওযী তাঁর ’ওয়াফা আল-ওয়াফা’ কেতাবে বলেন:
”এয়াযীদ তার চাচাতো ভাই উসমান বিন মোহাম্মদ বিন আবি সুফিয়ানকে মদীনার শাসক পদে নিয়োগ করে। উসমান উপহার সামগ্রীসহ এক প্রতিনিধি দল প্রেরণ করে এয়াযীদের কাছে তারই আনুগত্যের শপথ নেয়ার উদ্দেশ্যে। কিন্তু প্রতিনিধি দলের প্রত্যাবর্তনশেষে এর সদস্যরা বলেন, ‘আমরা এমন এক লোকের সাথে সাক্ষাৎ করে এসেছি যার কোনো ধর্ম নেই; সে মদ্যপান করে, বাদ্যযন্ত্র বাজায়, গায়িকা (ভ্রষ্টা নারী) ও কুকুর সাথে রাখে। আমরা তার প্রতি আনুগত্যের শপথ প্রত্যাহার করে নেয়ার কথা ঘোষণা করছি।’ আবদুল্লাহ ইবনে আবি উমরু বিন হাফস মখযুমী বলেন, ‘এয়াযীদ আমাকে উপহার সামগ্রী দিয়েছিল। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এই লোক আল্লাহর একজন শত্রু এবং মদ্যপ। আমি যেভাবে আমার এমামা (পাগড়ী) মাথা থেকে সরিয়ে ফেলছি, ঠিক একইভাবে তার থেকে নিজেকে আলাদা করবো।”
১২/ - কুসতুনতুনিয়া-বিষয়ক হাদীসের অপব্যাখ্যার অপনোদন
”...তিনি মহানবী (দ:)-কে বলতে শুনেছেন, ‘নৌযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী আমার সাহাবীদের প্রথম দলটি বেহেশতী হবে।’ মহানবী (দ:) এর পর বলেন, ‘আমার সাহাবীদের মধ্যে প্রথম বাহিনী যারা (রোমক) সিজারের শহর (কুসতুনতুনিয়া তথা কনস্টানটিনোপোল/ইস্তাম্বুল) জয় করবে, তাদের গুনাহ মাফ করা হবে’।” [সহীহ বুখারী, ৪র্থ খণ্ড, হাদীস - ১৭৫]
প্রথমতঃ সিজারের শহর জয়ী প্রথম বাহিনীর মধ্যে এয়াযীদ ছিল না, যেমনটি আবু দাউদের সুনানে বর্ণিত সহীহ হাদীসে বিবৃত হয়েছে: হযরত আসলাম আবি ইমরান (রা:) বলেন, “আমরা কনস্টানটিনোপোল জয়ের উদ্দেশ্যে মদীনা হতে বের হই। আবদুর রহমান বিন খালেদ বিন ওয়ালিদ ছিলেন এই বাহিনীর প্রধান।” [সুনানে আবি দাউদ, ২য় খণ্ড, হাদীস নং ২৫১২; আলবানীও এই হাদীসকে সহীহ বলেছে তার ‘তাখরিজ’ পুস্তকে]
ইমাম তাবারী নিজ ‘তারিখ’ গ্রন্থে বলেন -
আবদুর রহমান বিন খালেদ বিন ওয়ালিদের সেনাপতিত্বে ৪৪ হিজরী সালে মুসলমান বাহিনী রোমে (কনস্টানটিনোপোল) প্রবেশ করেন এবং সেখানে গযওয়া (ধর্মযুদ্ধ) সংঘটিত হয়। [তারিখে তাবারী, ৪৪ হিজরীর ঘটনা, ০০৫ খণ্ড, ২১২ পৃষ্ঠা; কায়রোর ‘দারুল মা’আরিফ’ প্রকাশনী হতে প্রকাশিত]
অথচ এয়াযীদ আরও বহু পরে ওখানে যায়। উপরন্তু, তাকে সেখানে পাঠানো হয়েছিল শাস্তিস্বরূপ; আর সে ওই প্রথমে অংশগ্রহণকারী যোদ্ধাদের প্রতি বিদ্রূপাত্মক মন্তব্য করেছিল।
ইমাম ইবনে আসীর (রহ:) লিখেন:
”এই বছর, অর্থাৎ, ৪৯ বা ৫০ হিজরী সালে হযরত আমীরে মোয়াবিয়া (রা:) রোমের (কনস্টানটিনোপোল) উদ্দেশ্যে এক বিশাল বাহিনী প্রেরণ করেন। তিনি এর দায়িত্বভার অর্পণ করেন সুফিয়ান বিন আউফের প্রতি এবং তাঁর ছেলে এয়াযীদকে ওই বাহিনীর সাথে যেতে বলেন। কিন্তু এয়াযীদ ‘অসুস্থ হওয়ার ভান করে এবং যেতে অস্বীকৃতি জানায়’। যোদ্ধারা যখন ক্ষুধা ও রোগ-ব্যাধিগ্রস্ত হন, তখন সে ব্যঙ্গ করে কবিতায় বলে, ‘ফারকুদওয়ানা-এ মহা গযবে তারা পতিত হয়েছে; তাদের জ্বর বা অন্য যা-ই কিছু হোক, তাতে আমার যায় আসে না। কেননা, আমি বসে আছি উচ্চ ফরাশে (ম্যাট্রেস); আর আমার বাহুবন্ধনে আছে উম্মে কুলসুম (এয়াযীদের স্ত্রীদের একজন)।’
”হযরত আমীরে মোয়াবিয়া (রা:) যখন এই কবিতার শ্লোক সম্পর্কে জানতে পারেন, তখন তিনি এয়াযীদকে শপথ গ্রহণ করতে ও কনস্টানটিনোপোলে সুফিয়ান ইবনে আউফের সাথে যোগ দিতে বাধ্য করেন, যাতে করে ’সেও ইসলামের মোজাহিদদের মোকাবেলাকৃত কঠিন পরীক্ষার অংশীদার হতে পারে’ (এটি এয়াযীদের প্রতি শাস্তি ছিল)। এমতাবস্থায় এয়াযীদ অসহায় হয়ে পড়ে এবং তাকে যুদ্ধে যেতে হয়; আর হযরত আমীরে মোয়াবিয়া (রা:) তার সাথে আরেকটি বাহিনী প্রেরণ করেন।” [’তারিখে ইবনে আল-আসীর’, ৩য় খণ্ড, ১৩১ পৃষ্ঠা]
ইমাম বদরুদ্দীন আইনী (রহ:) বলেন:
”আমি বলি, অসংখ্য সাহাবী (রা:) হযরত সুফিয়ান ইবনে আউফ (রা:)-এর অধীনে যুদ্ধে গিয়েছিলেন এবং ‘এয়াযীদ ইবনে মোয়াবিয়ার নেতৃত্বে যান নি, কেননা সে তাঁদেরকে নেতৃত্বদানে অযোগ্য ছিল’।” [‘উমদাতুল কারী’, শরহে সহীহ আল-বোখারী, ১৪/১৯৭-১৯৮]
কনস্টানটিনোপোলে সেনা অভিযানের সার-সংক্ষেপ নিম্নরূপ:
* প্রথম আক্রমণ পরিচালিত হয় ৪২ হিজরী সালে। দ্বিতীয় দফায় আক্রমণ হয় ৪৩ হিজরীতে এবং এর সেনাপতি ছিলেন হযরত বসর বিন আবি আরকা।
* তৃতীয় অভিযান পরিচালনা করা হয় ৪৪ হিজরী সালে এবং এটি নেতৃত্ব দেন আবদুর রহমান বিন খালেদ বিন ওয়ালীদ। পরবর্তী অভিযান ছিল ৪৬ হিজরীতে যার সেনাপতি ছিলেন মালিক বিন আবদির্ রহমান ও আবদুর রহমান বিন খালেদ বিন ওয়ালীদ।
* ৪৭ হিজরীতে পরবর্তী অভিযান পরিচালনা করেন মালিক বিন হোবায়রা ও আবদুর রহমান বিন কায়েমী। ৪৯ হিজরী সালে কনস্টানটিনোপোল তিনবার আক্রমণ করা হয়। আর সর্বশেষ ৫০ হিজরীতে যে অভিযান পরিচালিত হয় তাতে এয়াযীদ যোগ দেয় ।
হযরত আমীরে মোয়াবিয়া (রা:) এয়াযীদকে আটক করে সিজারের ওখানে পাঠান, কারণ সে মোজাহিদীনবৃন্দের প্রতি বিদ্রূপ করতো। তাই শাস্তিস্বরূপ তাকে ওখানে পাঠানো হয়েছিল, জ্বেহাদের জন্যে নয়।
অতএব, এয়াযীদ সপ্তম সেনা অভিযানে অংশগ্রহণ করেছিল, প্রথম অভিযানে নয় । আর বোখারী শরীফে উল্লেখিত হয়েছে, “আমার উম্মতের মধ্যে সিজারের নগরী আক্রমণকারী প্রথম সেনা দলের পাপ-পঙ্কিলতা মাফ করা হবে।”
রেফারেন্স:
আল-বেদায়া ওয়ান্ নেহায়া
ইবনে খালদুনের ইতিহাস
ইমাম ইবনে আসীরের ইতিহাস
১৩/ - এয়াযীদের কুরআন প্রত্যাখ্যান
নিচের রেফারেন্সগুলো দেখুন -
১. আল-বেদায়া ওয়ান নেহায়া ৮ম খণ্ড, ২০৪ পৃষ্ঠা, যিকর রাস আল-হুসাইন
২. মিনহাজ আস্ সুন্নাহ ২য় খণ্ড, ২৪৯ পৃষ্ঠা, যিকর এয়াযীদ
৩. শরহে ফেকাহে আকবর, ৭৩ পৃষ্ঠা, যিকর এয়াযীদ
৪. শরহে তাফসীরে মাযহারী, ৫ম খণ্ড, ২১ পৃষ্ঠা, সূরাহ ইবরাহীম
৫. শাযরাহ আল-যাহাব, ৬৯ পৃষ্ঠা, যিকরে শাহাদাতে হুসাইন
৬. মাকাতাহিল হুসাইন ২য় খণ্ড, ৫৮ পৃষ্ঠা, যিকরে শাহাদাতে হুসাইন
৭. তাযকিরায়ে খাওওয়াস, ১৪৮ পৃষ্ঠা
৮. তারীখে তাবারী ১১তম খণ্ড, ২১-২৩ পৃষ্ঠা, যিকর ২৮৪ হিজরী
৯. তাফসীরে রূহুল মা’আনী (সূরা মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)
১৪/ - তাফসীরে রূহুল মা’আনী গ্রন্থটি এয়াযীদকে কাফের ঘোষণা করে
আল্লামা আলূসী বলেন, ”অপবিত্র এয়াযীদ রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর রেসালতকে অস্বীকার করেছিল। মক্কা মোয়াযযমা ও মদীনা মোনাওয়ারার মুসলমান সর্বসাধারণ এবং মহানবী (দ:)-এর পরিবার সদস্যদের প্রতি যে (অসভ্য) আচরণ সে করেছিল, তাতে প্রমাণ হয় যে সে কাফের (অবিশ্বাসী) ছিল।”
আমীরুল মোমেনীন (খলীফা) উমর ইবনে আব্দিল আযীযের দরবারে একবার মানুষেরা এয়াযীদ সম্পর্কে আলোচনা করছিলেন। এমন সময় মানুষের মধ্যে কেউ একজন এয়াযীদকে ‘আমীরুল মোমেনীন’ বলে সম্বোধন করে। এতে খলীফা রাগান্বিত হয়ে ওই লোককে জিজ্ঞেস করেন, ‘তুমি (দুশ্চরিত্র, দুরাত্মা) এয়াযীদকে আমীরুল মোমেনীন হিসেবে ডাকো?’ অতঃপর খলীফা উমর ইবনে আবদিল আযীয ওই লোককে ২০টি দোররা মারার নির্দেশ দেন। [তাহযিবুত্ তাহযিব ১ম খণ্ড, ৩৬১ পৃষ্ঠা]
১৫/ - এয়াযীদের প্রতি লা’নত তথা অভিসম্পাত দেয়ার প্রমাণ
এয়াযীদের প্রতি অভিসম্পাত দেয়ার প্রমাণ বের করা হয়েছে নিম্নবর্ণিত আয়াতটি থেকে যা আল-বরযানজি নিজ ’আল-আশয়াত’ কেতাবে এবং ইমাম হায়তামী তাঁর ‘আস্ সাওয়াইক’ পুস্তকে বর্ণনা করেছেন ইমাম আহমদ (রহ:) হতে এই মর্মে যে, ইমাম সাহেবের পুত্র আবদুল্লাহ এয়াযীদের প্রতি লা’নত বর্ষণের পক্ষে কুরআন মজীদের কোথায় প্রামাণ্য দলিল আছে সে ব্যাপারে তাঁকে জিজ্ঞেস করেন। ইমাম আহমদ (রহ:) এর পক্ষে উদ্ধৃত করেন আল-কুরআনের বাণী: “তবে কি তোমোদের এ লক্ষণ দৃষ্টিগোচর হচ্ছে যে তোমরা শাসনক্ষমতা লাভ করলে পৃথিবীতে বিপর্যয় ডেকে আনবে এবং আপন আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করবে? এরা হচ্ছে ওই সব লোক যাদের প্রতি আল্লাহতা’লা অভিসম্পাত (লা’নত) দিয়েছেন...” (৪৭:২২-২৩)। বস্তুতঃ এয়াযীদ যে অপকর্ম করেছে, তার থেকে বড় কোনো ফিতনা আর হতে পারে কি? [তাফসীরে রুহুল মা’আনী, ৯ম খণ্ড, সূরা মোহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম), ২২-২৩]
Post a Comment